প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় বর্ধমান ৪ ফেব্রুয়ারি
“আমি আর কাউকে কামড়াবোনা। কাউকে খামচাবোনা ।খুলে দাও আমার পায়ে বেঁধে রাখা শিকল । আমি স্কুলে যাবো। “এই আকুতি শিকলের বাঁধনে শৈশব জীবন কাটানো পূর্ব বর্ধমানের কেতুগ্রামের কেউগুড়ি গ্রামের নাবালিকা মাম্পি খাতুনের । মেয়ে ফের যাদি কাউকে খামচে দেয় কিংবা কামড়ে দেয় তাহলে গ্রামবাসীরা আর ছেড়ে কথা বলবেনা।তাই নাবালিকা মেয়ের শত আকুতি উপেক্ষা করেই গ্রামবাসীদের নিদান মেনে তাঁর পায়ে শিকল জড়িয়ে তালা চাবির বাঁধন দিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছেন বাবা -মা। শিকলে বাঁধা শৈশব জীবন থেকে আদৌ মুক্তি মিলবেকিনা তার উত্তর অবশ্য নাবালিকার কাছে অজানাই রয়েগেছে ।
কেতুগ্রাম ২ ব্লকের শিতাহাটি পঞ্চায়েতের কেউগুড়ি গ্রামে বসবাস নাবালিকার পরিবাবের । বাবা মিরাজ সেখ দিন মজুরের কাজ করেন। মা সাবিনা বিবি সংসার সামলানোর পাশাপাশি ১০০ দিনের কাজও করেন। অ্যাজবেস্টার্স চালার দু’কুটুরি ঘরে মেয়ে মাম্পিকে নিয়ে তাঁরা থাকেন। মঙ্গলবার
মিরাজ সেখের বাড়িতে পৌছে দেখাগেল বাড়ির একটি ঘরে পায়ে শিকল ও তালাচাবি বাঁধা অবস্থায় বসে রয়েছে মাম্পি খাতুন । কেন মাপ্পিকে শিকলের বাঁধনে বেঁধে রাখা হয়েছে ? এই প্রশ্ন শুনে মাপ্পি নিজেই বলেওঠে
“আমি দুষ্টমি করিবলে রেগেগিয়ে গ্রামের সবাই বাড়িতে এসে বলে গেছে আমাকে বেঁধে রাখতে । তাই মা আমার পায়ে শিকলের বাঁধন দিয়ে রাখে । এর জন্য আমার কষ্ট হয় । মাম্পি আরো বলে , আমার স্কুল যেতে ইচ্ছা করে। আমি আর কাউকে খামচাবোনা, কামড়াবোনা । আমার পায়ের শিকল খুলে দিলে আমিও স্কুল যাব। ”
মেয়ে মাম্পি এমন আকুতির কথা শোনালেও মা সাবিনা বিবি ও বাবা মিরাজ সেখ অবশ্য তাঁদের অসহায়তার কথাই শোনালেন ।তাঁরা বলেন ,“মাম্পি আমাদের একমাত্র সন্তান । কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আমাদের একমাত্র মেয়ে মানসিক ভাবে সুস্থ নয় । বর্ধমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং কলকাতার হাসপাতালে মেয়ের চিকিৎসা করিয়ে ছিলেন ।পরে বহরমপুরে মেয়েকে নিয়েগিয়েও এক চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা করান ।কিন্তু টাকা পয়সা আর জোগাড় করতে না পারায় পরবর্তি সময়ে মাম্পির আর চিকিৎসা করাতে পারেননি । তবুও মেয়েকে গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন । সেখানে শিক্ষকরা মাপ্পিকে আগলে রাখতেন । প্রাথমিকের পাঠ সম্পূর্ণ করার পর ভয়ে মাম্পিকে আর হাই স্কুলে ভর্তি করেন নি । কারণ মানসিক ভাবে অসুস্থ মাম্পি কখনও কারুর বাচ্চাকে খামচে দিয়ে আবার কারুর বাচ্চাকে কামড়ে দিয়ে আহত করত । কোন কোন সময়ে আবার ঘরথেকে বেরিয়ে মাম্পি দূরগামী বাসে চড়ে বসছিল । এই সবের কারণে গ্রামের সবাই রেগে খাপ্পা হয়েযায় । তারা স্পষ্ট জানিয়েদেই মাম্পির এই আচরণ তাঁরা আর বরদাস্ত করবেনা । গ্রামবাসীদের নিদান মেনেই প্রায় দু’বছর ধরে ঘরেতেই পায়ে শিকল তালাচাবি দিয়ে মাম্পিকে বেঁধে রাখতে হচ্ছে ।”
মাত্র ১২ বছর বয়সী নাবালিকা মাম্পির এই করুণ পরিণতি প্রসঙ্গে প্রতিবেশী মোমিনা বিবি বলেন, ‘দুঃখ জনক ঘটনা । কোন মা-ই চান না তাঁর একমাত্র সন্তানকে শিকলের বাঁধনে বেঁধে রাখতে । কিন্তু অন্যের সন্তানকে কামড়ে , খামচে দেয় বলে সবাই মাম্পির প্রতি রেগে খাপ্পা হয়েগেছে । তাই ওর বাবা- মা নিরুপায় হয়েই ওর পায়ে শিকলের বাঁধন পরিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছে । মোমিনা খাতুন বলেন সরকার কিংবা প্রশাসন মাম্পির চিকিৎসার ব্যবস্থা করেদিলে হয়তো মাম্পি সুস্থ হয়ে আবার স্কুল যেতে পারবে । মোমিনা বিবির মতোই গ্রামের অন্য মহিলারাও চাইছেন প্রশাসন অসহায় নাবালিকার পাশে দাঁড়াক । ’
কেতুগ্রাম ২ ব্লকের বিডিও অরিজিত দাস জানিয়েছেন ,’বুধবার আমি নাবালিকার বাড়িতে যাব । নাবালিকা ও তাঁর বাবা মায়ের সঙ্গে কাছথেকে সবিস্তার জেনে কাটোয়ার মহকুমা শাসকের সঙ্গে কথা বলেন । মহকুমা শাসকের পরামর্শ মেনে নাবালিকাকে বাঁধন মুক্ত করে তাঁর চিকিৎসার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে । ’
No comments
Post a Comment